শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী ২০২১, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশ-ভারত বিশেষ অংশীদারির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত নতুন ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুলশানে ইন্ডিয়ান হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে বাংলাদেশ সব সময় ভারতের অত্যন্ত বিশেষ অংশীদার ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’
এর আগে বিকেলে তিনি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয়পত্র পেশ করেন।
দুই দেশের বন্ধুত্ব সম্পর্কে বিক্রম দোরাইস্বামী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের বন্ধুত্ব কৌশলগত অংশীদারির অনেক ঊর্ধ্বে। কারণ এই বন্ধুত্ব রচিত হয়েছে অভিন্ন ত্যাগ, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মীয়তার অনন্য সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে।’ বাংলাদেশকে ভারত সর্বোচ্চ স্তরের গুরুত্ব দেয় এবং এটি কখনোই কমবে না বলেও জোর দিয়ে বলেন তিনি।
ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমাদের অন্যতম সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এ কারণেই কভিড মহামারির সময় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বন্ধ থাকলেও পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশকে তাঁর প্রথম সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অংশীদারির উৎস পারস্পরিক শ্রদ্ধা। ঐতিহাসিক জনযুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের ভিত্তিতে একটি জাতিকে রূপদানকারী হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের চেতনার প্রতি আমরা গভীর সম্মান জানাই ও প্রশংসা করি। আপনারা অসংখ্য মৃত্যু ও মা-বোনদের প্রতি বর্বর নির্যাতন উপেক্ষা করে অনন্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে অত্যাচার ও কঠোরতার মুখোমুখি হয়েছিলেন।’
বিক্রম দোরাইস্বামী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনাদের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধে আপনাদের সহায়তা করতে পারা আমাদের জন্য সব সময়ই সম্মানের বিষয় হয়ে থাকবে, যেভাবে প্রায় ৫০ বছর পরও আপনাদের সাহসের প্রতি আমরা সম্মান জানাই।’
ভারতের নতুন হাইকমিশনার বলেন, ‘সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য উন্নতির জন্য বাংলাদেশ আজ সমানভাবে সম্মানিত। একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম গতিতে আপনাদের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে আমরা আপনাদের বিশ্বখ্যাত আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার প্রশংসা করি।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সাফল্য বা ক্রিকেট পিচে টাইগারদের অপ্রতিরোধ্য মনোবল, যা-ই হোক না কেন সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে নতুন সম্মানের সঙ্গে দেখছে। এবং আপনাদের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে আমরা এই উপযুক্ত স্বীকৃতিতে আনন্দিত।’
দোরাইস্বামী বলেন, ‘এই চেতনায় এবং মুজিববর্ষ, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও আমাদের দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি, যারা আমাদের ইতিহাসের এই মুহূর্তে নিয়ে এসেছেন।’
বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ‘আমি আখাউড়া স্থলসীমান্ত থেকে সরাসরি ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর পরিদর্শন করে তাঁর উজ্জ্বল নেতৃত্বের প্রতি আমার বিনীত ও আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। আমি আগামীকাল (আজ শুক্রবার) সাভারে যাচ্ছি বাংলাদেশের সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।’
ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘আমি স্বীকার করি, নিকটতম সম্পর্কের পরিচর্যা করা প্রয়োজন। আমার সরকার আমাকে ঠিক তা-ই করার নির্দেশ দিয়েছে। আমি ও আমার সহকর্মীরা এই অংশীদারিকে সর্বস্তরে প্রচার করতে কোনো সুযোগই ছাড়ব না। আমরা উভয় পক্ষের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মাধ্যমে এই অংশীদারির পক্ষে সর্বোচ্চ সমর্থন জানাব।’
দোরাইস্বামী বলেন, ‘আমরা শিগগিরই ফ্লাইট চলাচল শুরু করতে বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় একটি বিশেষ এয়ার বাবল ব্যবস্থা চালু করব। আমরা কভিড মোকাবেলায় যৌথভাবে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা এমনভাবে কাজ করব, যাতে আপনারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং যা আপনাদের অগ্রাধিকারের প্রতি পূর্ণ সম্মান নিশ্চিত করে এবং এই বন্ধুত্বের প্রতি আমাদের মূল্যবোধকে প্রকাশ করে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আমরা যতই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের নেতারা আমাদের সম্পর্কের জন্য তাঁদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেবেন। আমাদের এই প্রচেষ্টায় গণমাধ্যমের বন্ধুদের সব সময় সহায়তা কামনা করি।’
বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাশা পূরণে আমি ও আমার সহকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনাদের সমর্থন ও শুভেচ্ছার জন্য কৃতজ্ঞ থাকব।’ বন্ধু, অংশীদার ও প্রতিবেশী হিসেবে ভারত সব সময় আপনাদের পাশে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
হাইকমিশনার হিসেবে অগ্রাধিকার কী থাকবে—কালের কণ্ঠ’র এই প্রশ্নের জবাবে বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, করোনার আগে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে গতি ছিল অন্তত সেটি তিনি ফিরিয়ে আনতে চান। একই সঙ্গে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন, কানেক্টিভিটি জোরদারে অগ্রাধিকার দিতে চান। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্য অংশীদার—দুই ভূমিকাতেই তিনি এ দেশে আরো ভারতীয় ব্যবসা আনতে চান।
বিক্রম বলেন, তিনি বাংলাদেশিদের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবেন। আগামী বছর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের বছর। শীর্ষ পর্যায়ে সফর বিনিময়, বিশেষ করে ভার্চুয়াল ভিজিট এ বছরের শেষ দিকে হতে পারে।
বিক্রম আরো বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কের গুরুত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে এমন বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারেও আমি আশাবাদী।’ তিনি সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে গণমাধ্যমের গঠনমূলক সমালোচনা, পরামর্শ ও সমর্থন প্রত্যাশা করেন।
কভিড ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘এ বছরের শেষ নাগাদ কোনো না কোনোভাবে সম্ভাব্য ভ্যাকসিন প্রয়োগ উপযোগী হবে বলে আমরা আশাবাদী। ভারতীয় ভ্যাকসিনের ফেজ থ্রি (তৃতীয় ধাপের) ট্রায়াল বাংলাদেশেও করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ আগ্রহী হলে সেই ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহ বিষয়ে দুই দেশের সহযোগিতার সুযোগ আছে।’
বিক্রম বলেন, এসব বিষয়ে ভারতের দরজা বাংলাদেশের জন্য খোলা।
সীমান্তে হত্যার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আলোচনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সীমান্তে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন ও নিরুপায় ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, অমীমাংসিত সব ইস্যুতে উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে ভারত সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন কি না, জানতে চাইলে বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, তিনি সেই বার্তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার আগে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের জানাতে চান।