বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২১, ০৮:৩৩ অপরাহ্ন
মোহাম্মদ আইজুদ্দিন মিয়া। পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সারাজীবন ভাড়া বাসায় থাকলেও রাজধানী বা আশপাশের এলাকায় নিজের একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এরই মধ্যে ‘সহজ কিস্তিতে জমির মালিক’- এমন একটি চটকদার বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে তার।
দেরি না করে আইজুদ্দিন যোগাযোগ করেন নাসিম রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে। আর সেই যোগাযোগই কাল হয়ে যায় তার। ঢাকায় বাড়ি করার যে স্বপ্ন দেখতেন, প্রতারকের খপ্পরে পড়ে তার সেই স্বপ্ন গুড়েবালি হয়ে যায়। জীবনের অর্জিত সম্বলটুকু হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি।
আইজুদ্দিন জানান, নাসিম রিয়েল এস্টেট থেকে তাকে জানানো হয়েছিল প্রতিমাসে ৮ হাজার ৬০০ টাকা কিস্তি দিতে হবে। এমন ১০০ কিস্তি দিলেই তিন কাঠার একটি প্লটের মালিক হবেন তিনি। স্বপ্নপূরণের সুযোগ ভেবে প্রতিমাসে তিনি নিয়মিত কিস্তির টাকা দিতে থাকেন। অর্ধেকের বেশি কিস্তি জমা দেয়ার পর আইজুদ্দিন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এরপর টাকা ফেরত চেয়েও পাননি। শুধু তিনি নন, এমন অনেকেই নাসিমের খপ্পরে পড়ে সব হারিয়েছে।
এরপর গত ২ অক্টোবর রাজধানীর রূপনগর এলাকায় একটি গোপন আস্তানায় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক ইমাম হোসেন নাসিম। তার নামে ৫৫টি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
নাসিমের আস্তানা থেকে অস্ত্র, মাদকসহ নানা জিনিসও জব্দ করে পুলিশের এই এলিট ফোর্সটি। এর মধ্যে ছিল একটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ মি.মি. বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, এক লাখ ৩৫ হাজার টাকার জাল নোট, এক হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা, দুই বোতল বিদেশি মদ, চারটি ওয়াকিটকি সেট, ছয়টি পাসপোর্ট, ৩৭টি ব্যাংক চেকবই এবং ৩২টি সিমকার্ড। এ সময় হালিমা আক্তার সালমা নামে তার এক সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে নাসিমের বিরুদ্ধে র্যাব বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে দুটি, মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় একটি মামলা করে। র্যাবের হাতে নাসিমের গ্রেপ্তার হওয়ার পরে আইজুদ্দিন মিয়া প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হন। জীবনের অর্জিত সম্বলটুকু হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি।
আইজুদ্দিন বলেন, নাসিম আমার ৫ লাখ ৪ হাজার ২ শ টাকা আত্মসাৎ করেছে। নাসিম রিয়েল এস্টেট কিস্তিতে প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সাভারের কাউন্দিয়ায় তিন কাঠার একটি প্লটও দেখায় তারা। আমি ৫৯টা কিস্তি দেয়ার পরে তাদের প্রতারণার বিষয়টি টের পাই। কিন্তু তখন টাকা ফেরত চাইলে তারা দেয়নি।
আইজুদ্দিন মিয়া আরও বলেন, নাসিমকে তো র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। আমরাও র্যাবের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। শাহ আলী থানায়ও গিয়েছিলাম। তারা বলেছে, আমরা অভিযোগ রিসিভ করে রাখবো। আরও অনেকের অভিযোগ আছে। সব কাগজ একত্রিত করে তারপর আমরা একটা মামলা নেবো।
এ বিষয়ে র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এখন পর্যন্ত অনেকগুলো অভিযোগ আমরা পেয়েছি। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আমরা অভিযোগগুলো একত্রিত করে সিআইডিতে পাঠিয়েছি। পাশাপাশি অনুমতি নিয়ে আমরা চেকের কিছু ফটোকপিও পাঠিয়েছি। মামলা র্যাবের অধীনে তদন্তের জন্য আবেদিন করেছি। তদন্তের জন্য মামলা হাতে আসতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগে।
এদিকে নাসিম রিয়েল এস্টেটের প্লট বুকিং দিয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজিব চৌধুরী নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তাও। তিনি তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে টাকা দিয়েছিলেন।
রাজিব চৌধুরী বলেন, আমাদেরই এক ভাই হেলাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি নিউ মডেল হাইস্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুলের শিক্ষকরা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন মিলে ১৫০ থেকে ২০০টি প্লট বুকিং দেই। আমরা এককালীন ২০ হাজার টাকা করে জমা দিয়েছিলাম। তিন কাঠার একটি প্লট দেখিয়ে ৩ লাখ টাকার কিস্তি ধরিয়ে দেয়। আমি ৩ লাখ টাকার কিস্তির মধ্যে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। ৫০ হাজার টাকা জমি ভরাট করার জন্য দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা তো পরে আর কিছুই করেনি। প্রতিবার জিজ্ঞাসা করতাম মাটি ফেলবেন কবে? আমাদের জায়গা দেয়ার কথা ছিল আশুলিয়ার তামান্না পার্কের দক্ষিণ পাশে নাসিম রিয়েল এস্টেটের প্রতিষ্ঠান ‘নাসিম সিটি’ নামের একটি হাউজিং প্রকল্পে।
রাজিব বলেন, আমরা সবাই মিলে র্যাব-৪ এ কাগজপত্র জমা দিয়েছি। নিউ মডেল হাই স্কুলের শিক্ষক, বিভিন্ন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও শিক্ষকদের আত্মীয় স্বজনরাও নাসিমের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন।